সাপের কামড় থেকে বাঁচার উপায় এবং বিষাক্ত সাপের দংশনে প্রাথমিকভাবে আপনার করণীয় কি?

 

বাংলাদেশে গোখরো, কেউটে এবং ভাইপার পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মোট ৩৩ প্রজাতির বিষধর সাপের প্রাদুর্ভাব আছে।

বর্ষাকালে সাপ নিজের আস্তানা থেকে বের হয়ে আসে যে কারণে এই সময় সাপের কামড়ে আক্রান্ত হবার ঘটনা বেশি। প্রায় ৮০ ভাগ সাপে কামড়ের ঘটনা ঘটে জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। এছাড়া বন্যা/ভুমিকম্পজনিত প্রাকৃতিক দূর্যোগে এবং ফসল তোলার সময় সাপের উপদ্রব বাড়ে। গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত প্রতি ১ লক্ষ মানুষের মধ্যে ৬২৩ জন সাপের কামড়ে আক্রান্ত হয় এবং প্রতি বছর প্রায় ৬০৪১ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন।

আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে বেশিরভাগ গরীব জনগোষ্ঠীর এবং কম বয়সী মানুষ যারা জীবিকার প্রয়োজনে ঘরের বাহিরে কাজ করেন। ১০-১৯ বছর বয়সী মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। চাষাবাদ, মাছ ধরা, কাঠ সংগ্রহ, বাগান করা প্রভৃতি কাজের সাথে এই ঝুঁকি সংশ্লিষ্ট। খালি পায়ে হাঁটা এবং মেঝেতে ঘুমানোর ফলে সাপে কামড়ের ঘটনা বাড়তে পারে যার কারণে শিশু এবং গৃহিণীরাও বিষাক্ত সাপের কামড়ে মৃত্যুবরনের ঝুঁকিতে থাকে। বসতবাড়ি এবং তার নিকটবর্তি স্থানে প্রায় ৫৯ ভাগ সাপে কামড়ানোর ঘটনা ঘটে।

অনেক ক্ষেত্রেই (as high as 85%) দেখা যায় সাপ বিষহীন। আবার বিষাক্ত সাপও সকল কামড়ে পর্যাপ্ত বিষ দিতে পারেনা। একে Dry bite বলে।

গোখরো সাপের ৩০% কামড় এবং চন্দ্রবোড়া (Russel viper)-এর ৫০% কামড়ে মানুষের শরীরে পর্যাপ্ত বিষক্রিয়া তৈরি করার মত বিষ থাকেনা। ড্রাই বাইটের হার সকল প্রজাতির বিষাক্ত সাপের ক্ষেত্রে এক নয়, তবে গড়ে ৫০% ক্ষেত্রে বিষাক্ত সাপ ছোবল দিলেও তাতে মানুষের শরীরে মারাত্মক বিষক্রিয়া তৈরি করার মত পর্যাপ্ত বিষ থাকেনা। অনেক বিষহীন সাপ আছে যেগুলোর শারীরিক বৈশিষ্ট্য বিষধর সাপের মত।

ওঝার প্রতি ভুলভাবে মানুষের যে বিশ্বাসের জন্ম তার মূল কারণ বিষহীন সাপের কামড় এবং বিষাক্ত সাপের দেয়া ড্রাই বাইট, এখানে ওঝার কোন কৃতিত্ব নেই।


সাপের ছোবল থেকে বাঁচার উপায় 👇

🔹ছোট পাখি, ইঁদুর, ব্যাঙ ইত্যাদি সাপের খাবার। তাই ঘরের ভেতর পাখি পালন করবেন না এবং ইঁদুরের উপদ্রব কমানোর জন্য ধান, গম ইত্যাদি শস্য ঘরের বাইরে রাখবেন। 

🔹সাপ বেশিরভাগ (প্রায় ৭১%) ক্ষেত্রে পায়ে ছোবল দেয়।

ঝোঁপঝাড়ে কাজ করার জন্য লম্বা রাবারের জুতা এবং ফুলপ্যান্ট পরবেন। কোন গর্তে খালি হাত-পা ঢোকাবেন না। মাছ ধরার জালে সাবধানে হাত দিন, সামুদ্রিক সাপের লেজ চেপ্টা হওয়ায় মুখ এবং লেজ সহজে বোঝা যায়না।

খড়ের গাদা, কাঠের স্তুপ, বড় পাথর বা বড় কাঠের টুকরো অসতর্কভাবে সরাবেন না। রাতের বেলা ভুলক্রমেও লাকড়ির জন্য কাঠ সংগ্রহ করবেন না।

🔹সাপ সাধারণত রাতে চলাফেরা করে। তাই রাতে বাইরে বের হবার সময় টর্চ লাইট এবং লাঠি সঙ্গে নিয়ে বের হবেন।

বিশেষ করে বৃষ্টি হবার পর, কারণ বৃষ্টির পানিতে সাপের আস্তানা পূর্ণ হলে সাপ গর্ত থেকে বের হয়ে আসে অথবা আবর্জনার সাথে ধুয়ে এসে সাপ রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে পারে।

🔹মেঝেতে ঘুমানো পরিহার করুন বিশেষ করে ফসল তোলার মৌসুমে। মেঝেতে ঘুমানোর সময় সাপে কামড়ানোর ঝুঁকি ৬ গুণ বেশি। এই ঝুঁকি কমানোর জন্য ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারী ব্যাবহার করুন এবং ভাল করে তোষকের নিচে গুঁজে দিন।

🔹সাপ এমবুশ প্রিডেটর অর্থাৎ এটি অন্ধকার লুকানো স্থান থেকে আক্রমণ করে। ঝোঁপ, খড়ের গাদা, ঘাস/পাতা/কাঠের স্তুপ প্রভৃতি স্থানকে সাপ নিরাপদ জায়গা ভেবে লুকিয়ে থাকে। বাড়ির নিকটবর্তী স্থানে এসব রাখার অর্থ সাপকে আমন্ত্রণ জানানো।  এগুলো বাসস্থান হতে দূরে সরিয়ে নিন এবং চারপাশ নিয়মিত পরিষ্কার রাখুন। এছাড়া পিঁপড়ের ঢিবি, গাছের কোটর, মাটির দেয়ালের ফাটল ইত্যাদি সাপ লুকিয়ে থাকার আদর্শ স্থান। তাই বসতবাড়ির নিকটবর্তী এমন গর্ত পূরণ করে ফেলুন। গাছের কোন ডাল বসতবাড়ির সাথে স্পর্শ করে থাকলে সেই ডাল কেটে ফেলুন।

🔹অন্ধকার স্থানে প্রবেশের পূর্বে আলো জ্বালিয়ে নিন। লাঠি দিয়ে মাটিতে জোরে আঘাত করুন। সাপ বাতাসে ভেসে আসা শব্দ খুবই কম শুনতে পায় কিন্তু মাটিতে উৎপন্ন কম্পনের প্রতি খুব সেনসিটিভ। তাই শব্দ নয় বরং মাটিতে আঘাত করলে সাপ সতর্ক হয়ে নিরাপদ দূরত্বে সরে যাবার সময় পায়।

🔹পশুপাখির আচরণ লক্ষ্য করুন, বিশেষ করে পাখিদের আচরণ। এরা বিষধর সাপের উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করতে পারে।

🔹সাপ আপাতদৃষ্টিতে মৃত মনে হলেও খুব সতর্ক থাকবেন। কারণ এটি মরার ভান করতে পারে। সাপ মৃত ভেবে মানুষের চলাচলের পথে ফেলে রাখবেন না, অর্ধমৃত সাপ এমনকি মাথা থেঁতলে যাওয়া সাপও অনেকসময় রিফ্লেক্স বাইট দিতে পারে।

🔹রাস্তায় ইচ্ছাকৃতভাবে সাপের ওপর যানবাহন উঠিয়ে দিবেন না। আহত সাপ অন্য কোন পথযাত্রীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে, আবার চাকার সাথে আঁটকে গিয়ে আপনার বাড়িতে আশ্রয় নিতে পারে।

আমাদের দেশে কেউটে (Krait), গোখরো (Cobra) এবং Green pit viper প্রজাতির বিষাক্ত সাপে কামড়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। তবে ২০১৩ সালের পর থেকে রাসেল ভাইপারের কামড়ে মৃত্যুবরণের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় কেউটে এবং গোখরো সাপের নিউরোটক্সিক বিষের কারণে। 

শঙ্খিনী (Branded Krait) এবং কালকেউটে (Greater black krait) প্রজাতির কেউটে সাপ, পদ্মগোখরো (Monocled Cobra) প্রজাতির গোখরো সাপ এবং গ্রিন পিট ভাইপার বাংলাদেশের সব জেলায় বিস্তৃত।  

গোখরো এবং রাসেল ভাইপার ধানক্ষেতে থাকতে পারে।

এছাড়া গোখরো সাপ চিলেকোঠা কিংবা ঘরের মেঝেতে থাকা গর্তেও বসবাস করতে পারে। গ্রিন পিট ভাইপার ফলের বাগানে থাকতে পারে। কেউটে রাতে খাবার সন্ধানে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে ঘুমের মধ্যে ছোবল দিতে পারে। কেউটে এবং সামুদ্রিক সাপের কামড়ে অনেক ক্ষেত্রেই বিষদাঁতের ক্ষত বোঝা যায়না এবং আক্রান্ত স্থানে তেমন কোন লক্ষণ তৈরি হয়না। একারণে অনেক সময় আক্রান্ত ব্যাক্তি কেউটের ছোবলের পরেও ঘুম ভেঙে ওঠেনা।


কোন ব্যাক্তি সাপের কামড়ে আক্রান্ত হলে প্রাথমিকভাবে কি করবেন?

🔹প্রথমেই আক্রান্ত ব্যাক্তিকে আশ্বস্ত করুন, বেশিরভাগ সাপের কামড়ে কোন বিষ থাকেনা এমনকি বিষাক্ত সাপ কামড়ালেও সবসময় পর্যাপ্ত বিষ শরীরে প্রবেশ করেনা।

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ সাপের কামড়ে বিষ না ঢুকলেও ব্যাক্তিটি vasovagal shock এ আক্রান্ত হতে পারেন। তীব্র প্যানিকের কারণে বিষাক্ত ছোবল না হলেও বিভ্রান্তিকর লক্ষণ প্রকাশ পাবে। তাছাড়া পরবর্তী সময় আক্রান্ত ব্যাক্তি দীর্ঘমেয়াদী মানসিক সমস্যায় ভুগতে পারেন।

🔹আক্রান্ত স্থানে বিষদাঁতের ক্ষত আছে কিনা পরীক্ষা করুন।

🔹আক্রান্ত হাত কিংবা পা নাড়ানো যাবেনা। পায়ে ছোবল দিলে হাঁটু সোজা রেখে বসে পড়ুন, হাঁটা যাবেনা। হাতে ছোবল দিলে আক্রান্ত হাত নাড়াবেন না। আক্রান্ত অংশ নড়াচড়া করলে মাংসপেশির সংকোচনের ফলে বিষ দ্রুত ছড়াবে।

🔹আক্রান্ত স্থান ফুলে গিয়ে আটকে যেতে পারে এমন যেকোন অর্নামেন্ট শরীর থেকে দ্রুত খুলে ফেলুন।

🔹ক্ষতস্থান সাবান-পানি কিংবা ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দিতে পারেন, তবে কোনক্রমেই ঘষা যাবেনা। ব্যান্ডেজ দিয়ে ক্ষতস্থান ঢেকে দিন।

🔹হাঁড় ভাঙলে যেভাবে splint বা sling দেয়া হয় অনুরূপ পদ্ধতিতে আক্রান্ত অংশ স্থির রেখে, এন্টিভেনোম দেয়ার ব্যাবস্থা আছে এমন নিকটবর্তী হাসপাতালে যত দ্রুত সম্ভব নিয়ে যাবেন। তবে Pressure immobilization এর জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যাক্তি থাকলে বিষ ছড়ানো প্রতিরোধে এটি সবচেয়ে ভালো উপায়।

🔹আক্রান্ত ব্যাক্তিকে একপাশে কাত করে শোয়ান এবং ক্ষতস্থান হার্টের লেভেলের নিচে রাখুন।

শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে মুখ দিয়ে কৃত্তিমভাবে শ্বাস দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

🔹সাপ মারার জন্য সময় নষ্ট করবেন না। তবে সাপকে যদি ইতোমধ্যেই মেরে ফেলা হয় সেক্ষেত্রে মৃত সাপের প্রজাতি সনাক্তের জন্য হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। আনাড়ী হাতে অথবা খালি হাতে মৃত সাপ ধরবেন না কারণ সাপ মৃত হবার ভান করতে পারে, এমনকি থেঁতলে যাওয়া মাথাও অনেকসময় রিফ্লেক্স বাইট দিতে পারে।


সাপে আক্রান্ত ব্যাক্তির ক্ষেত্রে যে কাজগুলো করবেন না 👇

🔹আক্রান্ত হাত/পা দড়ি দিয়ে বাঁধা যাবেনা। দড়ি দিয়ে বেঁধে বিষ ছড়ানো সামান্য পরিমাণেও প্রতিরোধ করা যায়না। বরং শক্ত বাঁধনের ফলে অথবা আক্রান্ত স্থান ফুলে গিয়ে রক্তসঞ্চালন বন্ধ হয়ে যায় এবং এই অবস্থায় ৪০ মিনিট বা তার বেশি সময় থাকলে আক্রান্ত অঙ্গ সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে ইতোমধ্যে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেললে সেটি খুলতে যাবেন না এবং যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।

🔹আক্রান্ত স্থান কাটবেন না, সুঁই ফোটাবেন না। আক্রান্ত স্থানে কোন কিছুই মাখবেন না যেমন ক্রিম, গাছের বাকল বা রস, এসিড প্রভৃতি। আক্রান্ত স্থান ম্যাসাজ করবেন না।

🔹আক্রান্ত ব্যাক্তিকে মুখে কিছু খাওয়াবেন না।

🔹ওঝার নিকট গিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না।


তথ্যসূত্র : 🔸 National guidelines for the management of snake-bites in Bangladesh 2018

🔸WHO SEARO guidelines for the management of snake-bites


ধন্যবাদ। 

©Dr. A. N. RAKIB

Healthy Horizons Bangladesh

Comments